বাংলাদেশ

সেনাবাহিনীর ২১ দিনের অভিযান গ্রেপ্তার ৯৯৬, অস্ত্র-মাদক উদ্ধার

দেশব্যাপী নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করতে গত ২১ দিনে সেনাবাহিনী ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করে ৯৯৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এই অভিযানে ধরা পড়েছেন চিহ্নিত সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি, দুষ্কৃতকারী গ্যাংয়ের সদস্যরা। পাশাপাশি উদ্ধার হয়েছে ৫৬টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, ৯৯০ রাউন্ড গুলিসহ বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ। এই অভিযানের পাশাপাশি চলতি বছরের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত মোট গ্রেপ্তার হয়েছে ১৫ হাজার ২৬২ জন, যাদের মধ্যে অনেকে কুখ্যাত অপরাধী হিসেবে তালিকাভুক্ত।

সেনাবাহিনী ও মাদক, সন্ত্রাস দমন অভিযান

ঢাকা সেনানিবাসে বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টরেটের স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম এসব তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি জানান, গ্রেপ্তারদের মধ্যে রয়েছে কিশোর গ্যাং, ডাকাত, অপহরণকারী, চাঁদাবাজ এবং মাদক ব্যবসায়ীরা। উল্লেখযোগ্যভাবে, গত ২৭ মে কুষ্টিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী এবং তাঁর সহযোগী মোল্লা মাসুদকে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হাতিরঝিল থেকে শুটার আরাফাত ও শরীফকেও আটক করা হয়েছে।

বিভিন্ন স্থানে অভিযান ও গ্রেপ্তারি

একই দিনে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বুড়িগঙ্গা ফিলিং স্টেশন এলাকা থেকে এক্সেল বাবু নামে এক দুষ্কৃতকারী ও তাঁর তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা, অপহরণ এবং ভূমি দখলের মামলা রয়েছে। ৪ জুন জেনেভা ক্যাম্প এলাকা থেকে ৩০টির বেশি মামলার আসামি বুনিয়া সোহেলকে আটক করা হয়; তাঁর সঙ্গীদের কাছ থেকে দেশীয় অস্ত্র, নগদ টাকা ও মাদক উদ্ধার করা হয়েছে।

৫ জুন কক্সবাজারের মাঝিরকাটা এলাকা থেকে শাহীন ডাকাত ও তাঁর দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ, মাদক ও চাঁদাবাজির ২০টির বেশি মামলা রয়েছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে চারটি আগ্নেয়াস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র ও মাদক।

৬ জুন কুষ্টিয়ার দূর্বাচর এলাকায় অভিযান চালিয়ে সন্ত্রাসী জাহাঙ্গীর কবির লিপটনসহ চারজনকে আটক করা হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে ছয়টি বিদেশি পিস্তল, একটি লং ব্যারেল গান, ১০টি ম্যাগাজিন ও ১১৯ রাউন্ড গুলি।

মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান ও সাফল্য

গত তিন সপ্তাহে মাদকবিরোধী অভিযানে ৪৫২ জন মাদক কারবারিকে আটক করেছে সেনাবাহিনী। চলতি বছরের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত মোট গ্রেপ্তার ৫ হাজার ৪৭৬ জন। ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, অবৈধ মদসহ বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার হয়েছে। ৬ জুন সাভারের লুটেরচরে গ্যাস লাইটার তৈরির আড়ালে পরিচালিত একটি মদ তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়ে ৮২০ লিটার মদ ও কাঁচামাল জব্দ করা হয়েছে।

সেনাবাহিনীর জনসেবামূলক কাজ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা

কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম সেনাবাহিনীর জনসেবামূলক কাজের কথাও তুলে ধরেন। তিনি জানান, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অতিবৃষ্টিতে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেনাবাহিনী দ্রুত সেখানে পৌঁছে স্থানীয়দের সহায়তায় বাঁধ মেরামত করে। এতে বড় ধরনের প্লাবন ঠেকানো সম্ভব হয়।

হবিগঞ্জে বন্যার সময় ৭ জুন ঈদের দিনে সেনাবাহিনীর ১৭ পদাতিক ডিভিশনের সদস্যরা দুর্গত মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ করেন। শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের অসন্তোষ কমাতে ২৭ মে সেনাসদরে একটি সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যাতে ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন ও বোনাস নিশ্চিত করা হয়।

ভেজালবিরোধী অভিযান ও খাদ্য নিরাপত্তা

মিরপুরে একটি চকলেট কারখানায় অভিযান চালিয়ে সেনাবাহিনী ৭ লাখ টাকা জরিমানা করেন এবং কারখানাটি সাময়িক বন্ধের নির্দেশ দেন। কর্নেল শফিকুল ইসলাম বলেন, “এই ধরনের অভিযানগুলোর মাধ্যমে সেনাবাহিনী খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।”

বিশ্লেষণ: কেন সেনাবাহিনী অভিযানের গুরুত্ব এত বেশি?

বাংলাদেশে সন্ত্রাস, মাদক, চাঁদাবাজি, এবং অন্যান্য অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সরকারি বিভিন্ন বাহিনী কাজ করছে। তবে সামরিক বাহিনী যখন নিরাপত্তা শৃঙ্খলা রক্ষায় সরাসরি ভূমিকা নেয়, তখন তাদের প্রশিক্ষণ, দক্ষতা ও দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেশের শান্তি বজায় রাখতে বড় ভূমিকা রাখে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেড়েছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, মাদক ব্যবসা ও সংগঠিত অপরাধ, যা সমাজে ভয়-আতঙ্ক সৃষ্টি করছে।

সেনাবাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারিরা দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই অভিযান সমাজের সাধারণ মানুষকে নিরাপদ ও শান্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।

অপরদিকে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেনাবাহিনীর দ্রুত সাহায্য এবং জনসেবামূলক কাজ দেশের সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রতীক। বিশেষ করে বাঁধ সংস্কার ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণে তাদের ভূমিকা প্রশংসনীয়।

সাম্প্রতিক অভিযানের মূল পয়েন্টসমূহ:

  • ২১ দিনে গ্রেপ্তার ৯৯৬ জন সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি ও দুষ্কৃতকারী।
  • ৫৬টি বিদেশি ও দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার।
  • ৯৯০ রাউন্ড গোলাবারুদ জব্দ।
  • আগস্ট থেকে ১৫,২৬২ জন গ্রেপ্তার, যাদের মধ্যে অনেকই কুখ্যাত অপরাধী।
  • মাদকবিরোধী অভিযানে ৪৫২ জন ধরা পড়েছে, আগস্ট থেকে মোট গ্রেপ্তার ৫,৪৭৬।
  • মাদকদ্রব্য হিসেবে ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা ও অবৈধ মদের বড় মজুদ উদ্ধার।
  • প্রাকৃতিক দুর্যোগে দ্রুত সাহায্য ও বাঁধ মেরামতের কাজ।
  • ভেজাল খাদ্য নির্মূল ও জরিমানা, সাময়িক কারখানা বন্ধ।

দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীর চলমান অভিযান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী। অপরাধ, সন্ত্রাস ও মাদকবিরোধী লড়াইয়ে তাদের সফলতা জাতির জন্য আশার আলো। পাশাপাশি জনসেবামূলক কাজের মাধ্যমে দুর্যোগ মোকাবিলা ও সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কারণে সেনাবাহিনী দেশের আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

এমন কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ দ্রুত একটি নিরাপদ ও সুস্থ সমাজ হিসেবে গড়ে উঠবে, যেখানে সাধারণ মানুষ স্বস্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে বসবাস করতে পারবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button