অর্থনীতি

বিশ্বব্যাংক থেকে বাংলাদেশকে ৬৪ কোটি ডলারের ঋণ

বাংলাদেশকে উন্নয়ন সহায়তা হিসেবে ৬৪ কোটি মার্কিন ডলারের একটি বড় ঋণ দিতে যাচ্ছে বিশ্বব্যাংক। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ প্রায় ৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ২০২৫ সালের ১৯ জুন, বৃহস্পতিবার, ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভায় এ ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়।

এই অর্থ দুইটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় হবে। প্রকল্প দুটি হলো—‘জ্বালানি খাত নিরাপত্তা জোরদার’ এবং ‘বায়ুমান উন্নয়ন প্রকল্প’। এর মধ্যে গ্যাস সরবরাহ নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য ৩৫ কোটি ডলার এবং বায়ু দূষণ কমিয়ে পরিবেশ উন্নয়নে ২৯ কোটি ডলার ব্যয় হবে।

বাংলাদেশের জ্বালানি খাত: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশে বর্তমানে গ্যাস সরবরাহ সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং গৃহস্থালি পর্যায়ে গ্যাসের ঘাটতি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই সংকট নিরসনে ‘জ্বালানি খাত নিরাপত্তা জোরদার’ প্রকল্পটি অত্যন্ত সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ।

এই প্রকল্পের আওতায় পেট্রোবাংলা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG) আমদানি আরও সহজ ও কার্যকর করার অবকাঠামো উন্নয়ন করবে। এতে করে শিল্প খাতে উৎপাদন বাড়বে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিরবচ্ছিন্নতা আসবে এবং গৃহস্থালি পর্যায়ে গ্যাস সংযোগের চাপ কমবে।

বিশ্বব্যাংকের অন্তর্বর্তীকালীন কান্ট্রি ডিরেক্টর গেইল মার্টিন বলেন, “গ্যাস সরবরাহে নিরাপত্তা বৃদ্ধি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জরুরি। এই প্রকল্প দেশের প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়ক হবে।”

বায়ুদূষণ: নীরব ঘাতক, যার বিরুদ্ধে লড়াই জরুরি

ঢাকা শহর বহুদিন ধরেই বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহর হিসেবে পরিচিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে ১ লাখ ৫৯ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। শুধু তাই নয়, এর ফলে দেশের স্বাস্থ্য খাতে যে আর্থিক ক্ষতি হয়, তা দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (GDP) প্রায় ৮.৩ শতাংশের সমান।

বিশ্বব্যাংকের ২৯ কোটি ডলারের অর্থায়নে পরিচালিত ‘বায়ুমান উন্নয়ন প্রকল্প’ ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে দূষণের উৎস চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এতে:

  • শিল্প ও যানবাহন থেকে নির্গত বায়ু দূষণ হ্রাস করা হবে
  • পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার উৎসাহিত করা হবে
  • নগর ব্যবস্থাপনায় দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা হবে
  • বায়ুর মান নিয়মিত মনিটরিং করা হবে

বিশ্বব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্ব

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই বিশ্বব্যাংক এই দেশের অন্যতম প্রধান উন্নয়ন অংশীদার। এখন পর্যন্ত তারা ৪ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বেশি অনুদান ও ঋণ দিয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, পরিবেশ ও প্রযুক্তি খাতে নানা উন্নয়ন প্রকল্পে এই অর্থ ব্যয় হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ উদীয়মান অর্থনীতি। উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে সংহত করে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) পূরণের ক্ষেত্রে এই সহযোগিতা কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

এলএনজি (LNG) আমদানির প্রয়োজনীয়তা

বাংলাদেশ বর্তমানে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু মজুদ ফুরিয়ে আসায় এই উৎস ক্রমশ অকার্যকর হয়ে উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG) আমদানিই একমাত্র সমাধান হিসেবে দেখা দিয়েছে।

বর্তমানে দেশে দুটি এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। নতুন প্রকল্পে এই অবকাঠামো উন্নয়ন, গ্যাস সংরক্ষণ, ও দ্রুত বিতরণে আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করা হবে।

ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা ও সম্ভাবনা

বিশ্বব্যাংকের এই বিনিয়োগ শুধু বর্তমান সমস্যার সমাধান নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ। এই দুটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের জ্বালানি খাতে স্থিতিশীলতা আসবে, পরিবেশের মান উন্নত হবে এবং নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এর মাধ্যমে:

  • কর্মসংস্থান বাড়বে
  • অর্থনীতির গতি ত্বরান্বিত হবে
  • দারিদ্র্য হ্রাস পাবে
  • দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হবে

বিশ্বব্যাংকের ৬৪ কোটি ডলারের এই ঋণ বাংলাদেশের জন্য সময়োপযোগী এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ। পরিবেশ রক্ষা ও জ্বালানি নিরাপত্তা—এই দুইটি খাতই দেশের উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তি। সঠিক পরিকল্পনা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই অর্থায়নকে সর্বোচ্চ কাজে লাগানো গেলে, বাংলাদেশ তার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এক নতুন যুগে প্রবেশ করবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button