বিশ্ব

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত, পুতিনের শান্তি প্রস্তাব ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্প্রতি একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব মেটাতে একটি সমঝোতা চুক্তি সম্ভব। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, সবার স্বার্থ রক্ষা করে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান টেকে যেতে পারে। তবে, ইসরায়েলের সাম্প্রতিক আক্রমণের পর ইরানি সমাজে নিজেদের নেতৃত্বের প্রতি যে সংহতি ও ঐক্য তৈরি হয়েছে, সেটি বিষয়টিকে জটিল করেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

পুতিনের বক্তব্যের সারমর্ম

পুতিন স্পষ্ট করে বলেছেন, “ইসরায়েল ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার পরিকল্পনা করতে পারে” — এই ধরনের ধারণা তিনি আলোচনার জন্য উপযুক্ত মনে করেন না। তার মতে, এই ধরণের আক্রমণ সংঘাতকে আরো জোরদার করবে এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস বাড়াবে।

তিনি আরও জানান, “আজকের ইরানে আমরা একটি দৃঢ় ঐক্যবদ্ধ সমাজ দেখতে পাচ্ছি, যা তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের চারপাশে শক্তভাবে আবদ্ধ হয়েছে। এটি একটি সংবেদনশীল পরিস্থিতি, যেখানে আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। তবে আমি বিশ্বাস করি, সবার সহযোগিতায় একটি যুদ্ধবিরতি এবং চুক্তির পথ খুঁজে বের করা সম্ভব।”

পুতিনের মতে, এই চুক্তি ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ইরানের শান্তিপূর্ণ বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচির অধিকারকেও সম্মান করবে।

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের পটভূমি

গত শুক্রবার ইসরায়েল আচমকা হামলা চালিয়ে ইরানের কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করে। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়ে এবং আকাশপথে পরস্পর হামলা চালানো হয়।

ইসরায়েল তাদের হামলার কারণ হিসেবে ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা থেকে বিরত রাখতে চাওয়া উল্লেখ করে, যা ইরান কঠোরভাবে অস্বীকার করে আসছে।

দক্ষিণ ইরানের বুশেহর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুই শতাধিক রুশ নাগরিক কর্মরত রয়েছেন, যারা রাশিয়ার পারমাণবিক শক্তি সংস্থা রোসাটমের অধীনে কাজ করেন। পুতিন বলেন, “আমরা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে একমত হয়েছি।”

রাশিয়া ও ইরানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক

২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পর থেকে মস্কো ও তেহরানের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দুই দেশ একটি বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তির ফলে রাশিয়া ইরানের বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ অব্যাহত রাখতে পারে এবং পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষা করতে পারে।

তবে, পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষ করে ইউক্রেনের মিত্ররা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে, ইরান রাশিয়াকে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করছে, যা ইউক্রেন যুদ্ধকে তীব্র করছে। তবে পুতিন এই অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করে বলেন, “ইসরায়েলের হামলার পর ইরান রাশিয়ার কাছে সামরিক সহায়তার জন্য অনুরোধ করেনি।”

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ও পুতিনের মধ্যস্থতা প্রস্তাব

রাশিয়ার মধ্যস্থতার প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথোপকথনে তিনি বলেন, “পুতিনকে প্রথমে ইউক্রেনের যুদ্ধে নিজেদের অবস্থা ঠিক করতে হবে, তারপর মধ্যস্থতার কথা ভাবা উচিত।”

পুতিনের মধ্যস্থতার প্রস্তাব নিয়ে ট্রাম্পের এই মন্তব্য বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন একটি বিতর্কের সূত্রপাত করেছে। ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার বিশ্ব রাজনীতিতে অবস্থান কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, ইরান-ইসরায়েল সংকট মেটাতে মস্কোর মধ্যস্থতা চাহিদা অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাচ্ছে।

ইসরায়েল ও রাশিয়ার সম্পর্ক

গাজার সংকট এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মস্কো ও তেল আবিবের মধ্যে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কিছুটা চাপের মুখে পড়েছে। তবুও ইসরায়েলে রুশ বংশোদ্ভূত মানুষের একটি বৃহৎ সম্প্রদায় রয়েছে, যারা দুই দেশের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করছে।

সামগ্রিক বিশ্লেষণ: ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ও বিশ্ব রাজনীতি

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার দ্বন্দ্ব শুধুমাত্র দুই দেশের সমস্যা নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ। পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, এবং বিশ্ব শক্তিগুলোর কূটনৈতিক কৌশল এতে সরাসরি জড়িত।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রস্তাব আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইতিবাচক সাড়া পেতে পারে, যদি বিশ্ব শক্তিগুলো তাদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সত্যিকার অর্থেই স্থায়ী শান্তি গড়ার জন্য কাজ করে।

শান্তির জন্য সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

বর্তমান ইরান-ইসরায়েল সংঘাত মেটাতে পুতিনের মধ্যস্থতা একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। তবে, এই পথ চলতে গেলে সকল পক্ষকে একযোগে কাজ করতে হবে, একে অপরের নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থকে সম্মান জানাতে হবে।

সামরিক আক্রমণ ও রাজনৈতিক উত্তেজনা থেকে উত্তরণের জন্য কূটনৈতিক আলোচনার বিকল্প নেই। বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা, এই সংকট দ্রুত একটি স্থায়ী শান্তিচুক্তিতে পরিণত হবে, যা শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্য নয়, সমগ্র বিশ্বকে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা দেবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button