অর্থনীতি

২০% প্লাস্টিক কারখানা বন্ধের পথে: মালিকদের দাবি, ভ্যাট কমিয়ে ৫% করা হোক

বাংলাদেশের অন্যতম ছোট ও মাঝারি শিল্পখাত প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনে মারাত্মক ধস দেখা দিয়েছে। গত দেড় বছরে এই খাতের প্রায় ২০ শতাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বা বন্ধ হওয়ার পথে রয়েছে। বিদ্যুৎ–গ্যাস সংকট, উচ্চ সুদের হার ও অতিরিক্ত ভ্যাটের চাপ এর জন্য দায়ী বলে অভিযোগ করছেন উদ্যোক্তারা।

আজ বুধবার রাজধানীর পল্টনে বাংলাদেশ প্লাস্টিকপণ্য উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিপিইএ) নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন সংগঠনের নেতারা।

১৫% ভ্যাটের পরিবর্তে ৫% করার দাবি

সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি শামীম আহমেদ বলেন,

“গৃহস্থালি ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের ওপর আগে ভ্যাট ছিল ৭.৫ শতাংশ, কিন্তু এবারের বাজেটে তা দ্বিগুণ করে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এটা বাস্তবসম্মত নয়। আমরা এ হার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছি।”

তিনি আরও বলেন, “এই খাতে হাজার হাজার মানুষ কাজ করছেন। কিন্তু এভাবে ভ্যাট বাড়লে অনেক প্রতিষ্ঠান আর টিকে থাকতে পারবে না।”

খেলনাশিল্পে ৮৭% শুল্ক ও কর: বিনিয়োগে বাধা

সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, শুধু গৃহস্থালি সামগ্রী নয়, প্লাস্টিক খেলনাশিল্পেও শুল্ক ও কর মিলিয়ে ৮৭% পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে, যা একেবারেই অযৌক্তিক। শামীম আহমেদ বলেন,

“এই খাতটি উদীয়মান। প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে চাইলে স্থানীয় উৎপাদকদের জন্য সহনীয় কর কাঠামো দরকার।”

বিদ্যুৎ–গ্যাস সংকটে উৎপাদন ব্যাহত

সংগঠনের সহসভাপতি এনামুল হক নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন,

“গাজীপুরে আমার কারখানায় দিনে ৮–১০ বার বিদ্যুৎ চলে যায়। অথচ একটি মেশিন গরম হতে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। এতে উৎপাদন বন্ধ থাকে, শ্রমিক বসে থাকে, আর বিলও বাড়ে।”

তিনি আরও বলেন, “শুধু ভ্যাট নয়, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহে যে সংকট আছে, সেটিও এই শিল্পকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।”

বাংলাদেশে প্লাস্টিক শিল্পের বর্তমান চিত্র

  • দেশে বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার ছোট-বড় প্লাস্টিক কারখানা রয়েছে
  • প্লাস্টিক খাত প্রায় ১২ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে
  • ৩০টির বেশি দেশে রপ্তানি হয় বাংলাদেশের প্লাস্টিক পণ্য
  • বার্ষিক বাজার প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি

অর্থনৈতিক সংকটের চাপে পড়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (SME)

গত এক বছরে ডলারের দাম বেড়ে যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে। তার ওপর ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১৩–১৪ শতাংশে উঠে যাওয়ায় উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। প্লাস্টিক খাতের মতো বহু SME প্রতিষ্ঠান এখন অস্তিত্ব সংকটে

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্লাস্টিক খাতের পতনের প্রভাব শুধু উৎপাদনে নয়—চাকরির বাজার, স্থানীয় বাজার ও রপ্তানি আয়েও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে

সরকারের কাছে দাবি: বাজেট পুনর্বিবেচনার আহ্বান

সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে, বাজেট পাস হওয়ার আগে ভ্যাট সংক্রান্ত অংশ পুনর্বিবেচনা করা হোক।
তারা ৩টি প্রধান দাবি উপস্থাপন করেন:

১. গৃহস্থালি প্লাস্টিক পণ্যে ভ্যাট ৫% করা
২. খেলনা শিল্পে শুল্ক-কর হার যৌক্তিক মাত্রায় নামানো
৩. বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং শিল্প খাতে তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বরাদ্দ দেওয়া

বিশ্লেষণ: কেন এই দাবি যৌক্তিক?

  • প্লাস্টিক পণ্য গৃহস্থালি ব্যবহারে অপরিহার্য, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে সরাসরি জড়িত
  • দেশের নিজস্ব উৎপাদক ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিদেশি পণ্য বাজার দখল করবে, যা রপ্তানি ও স্থানীয় শিল্প—দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত করবে
  • পণ্য উৎপাদনে ব্যয় বাড়লেও ভোক্তা তা বহন করতে পারবে না, ফলে উৎপাদক-ভোক্তা উভয়েই বিপদে পড়বে
  • বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় শুধু প্লাস্টিক নয়, সার্বিক শিল্প খাতেই ধস নামতে পারে

সরকারের নীতি কী বলছে?

বাজেট উপস্থাপনকালে অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশীয় শিল্পের বিকাশে ভ্যাট কাঠামোতে কিছু “সাময়িক চাপ” আসতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা রাজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে করা হয়েছে।

তবে শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, “দীর্ঘমেয়াদ” আসার আগেই বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে, তখন রাজস্ব আদায়েরও সুযোগ থাকবে না।”

বাংলাদেশের প্লাস্টিক খাত এক সময় ছিল সম্ভাবনার প্রতীক। কিন্তু বিদ্যমান সংকট, নীতিগত অসামঞ্জস্য ও কর কাঠামোর ভারে আজ তা ধ্বংসের মুখে। উদ্যোক্তাদের দাবি, সরকারের উচিত এখনই কারিগরি সহায়তা ও কর রেয়াত দিয়ে এই খাতকে রক্ষা করা।

এই খাত কেবল উদ্যোক্তার নয়—দেশের অর্থনীতির, কর্মসংস্থানের এবং রপ্তানির ভবিষ্যতের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button