প্রযুক্তি

ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কীভাবে কাজ করে ও কতদূর পৌঁছায়

ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হলো এমন ধরনের দূরপাল্লার অস্ত্র, যা শক্তিশালী রকেট ইঞ্জিনে উৎক্ষেপণ করে উপরের স্তরে নিয়ে যাওয়া হয়, তারপর তা বায়ুমণ্ডলে আবার প্রবেশ করে লক্ষ্যে আঘাত করে। পারমাণবিক বা প্রচলিত বিস্ফোরকগুলি এই ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারে।

প্রধান বৈশিষ্ট্য:

  • তিন পর্যায়ের ফ্লাইট: উত্তোলন (Boost), মধ্যপথ (Mid-course), এবং প্রবেশ (Terminal) পর্যায়
  • বেগ: ১ মাখ (Sound speed) থেকে শুরু করে ৫ মাখ বা তারও বেশি (হাইপারসনিক) ।
  • ফেটোরা: উচ্চ বেগ, মহাজাগতিক ট্রেজেক্টরি ও মাধ্যাকর্ষণ বল ব্যবহার করে বক্র পথচিহ্নে ভ্রমণ।

ফ্লাইট কিভাবে গঠিত?

১. উত্তোলন পর্যায় (Boost Phase)

  • ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের শুরু। রকেট ইঞ্জিন পুরো গতি তৈরি করে।
  • এক বা একাধিক ধাপে (Stages) ইঞ্জিন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত চলতে পারে। সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট সময় লাগে ।
  • অতঃপর ক্ষেপণাস্ত্র পূর্বনির্ধারিত ট্রাজেক্টরিতে চলে।

২. মধ্যপথ পর্যায় (Mid‑course Phase)

  • ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার পর ক্ষেপণাস্ত্র সাব-অরবিটাল বা মহাজাগতিক পথে ঢোকে এবং সবচেয়ে উচ্চে পৌঁছে।
  • একই গতি ধরে লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হয়, প্রায় অবাধ ভাবে ভ্রমণ করে ।
  • এই পর্যায়টি সবচেয়ে দীর্ঘ (একমাত্র ICBM ক্ষেত্রে ২০ মিনিট পর্যন্ত) ।

৩. প্রবেশ পর্যায় (Reentry / Terminal Phase)

  • ক্ষেপণাস্ত্র পুনরায় ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে, এই সময় তার গতি অনেক দ্রুত—6–8 km/s (প্রায় Mach 20) পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে ।
  • বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব বাড়ার সাথে সাথে বেগ হ্রাস পায় এবং শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে।

কীভাবে কাজ করে?

সঙ্গঠন:

  • এয়ারফ্রেম: ক্ষেপণাস্ত্রের কাঠামো ও কাভারিং।
  • ইঞ্জিন: তরল বা কঠিন জ্বালানি ইঞ্জিন ।
  • জ্বালানি: তরল (UDMH ইত্যাদি) বা কঠিন (solid propellant) ।
  • নির্দেশনা ব্যবস্থা: বাইর্যণাত্মক লক্ষ্যের দিকে নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ন্ত্রণ জন্য GNSS/INS ক্যামেরা/রাডার ।
  • পে-লোড / ওয়ারহেড: প্রচলিত, পারমাণবিক বা কেমিক্যাল বিস্ফোরক।

গাইডেন্স ও কন্ট্রোল:

  • নেভিগেশন: INS বা GPS মাধ্যমে সঠিক অবস্থান নির্ধারণ।
  • গাইডেন্স: পর্যায়ক্রমিক অ্যালগোরিদম, যেমন proportional navigation ব্যবহার করে পথ নির্দিষ্ট করা হয় ।
  • কন্ট্রোল: ফিন বা thrust-vectoring দিয়ে অ্যালগোরিদম অনুযায়ী ঘূর্ণন-দিকনা নিয়ন্ত্রণ করা হয় ।

দূরত্ব ও বেগ

পাল্লাবিশেষ:

ধরণদূরত্ব
যুদ্ধক্ষেত্র (BRBM)< ২০০ কিমি
স্বল্পপাল্লা (SRBM)< ১ ০০০ কিমি
মধ্যপাল্লা (MRBM/IRBM)১ ০০০–৩ ৫০০ কিমি
দীর্ঘপাল্লা (LRBM)৩ ৫০০–৫ ৫০০ কিমি
আন্তমহাদেশীয় (ICBM) ৫ ৫০০ কিমি
  • ICBM সাধারণত ৮০০০–১০ ০০০ কিমি পর্যন্ত পাল্লা রাখতে পারে ।
  • উদাহরণ: ভারতের Agni‑V মহাকাশে পৌঁছে ৭ ০০০–৮ ০০০ কিমি পর্যন্ত যাবে ।
  • চীনের DF‑5 ICBM-এর সম্ভাব্য পাল্লা ১৩ ০০০–১৬ ০০০ কিমি ।

বেগ:

  • স্বল্পপাল্লার SRBM: Mach 1–2 (১ ২০০–২৪০০ কিমি/ঘণ্টা) ।
  • দীর্ঘপাল্লার LRBM/ICBM: Mach 5 বা তারও বেশি (৬ ১২৫ কিমি/ঘণ্টা+) ।

সময় অংশ:

  • ইরান থেকে ইসরায়েলে (১ ৩০০–১ ৫০০ কিমি) Mach 5 গতি হলে পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র ~১২ মিনিট ।
  • Cruise missile এর সময় নেয় ~২ ঘণ্টা, ড্রোনের জন্য প্রয়োজন ~৯ ঘন্টা ।

প্রতিরক্ষা ও চ্যালেঞ্জ

কেন আটকানো কঠিন?

  • উচ্চ বেগ ও উচ্চতা থাকার কারণে প্রতিরক্ষণ ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া সময় সীমিত ।
  • প্রবেশ পর্যায়ে দ্রুত গতি এবং বায়ু ঘর্ষণ বাধা সৃষ্টি করে ।
  • কিছু ক্ষেপণাস্ত্রে ডিকয়, চাফ বা পাল্টা ব্যবস্থা থাকে, যা রাডার ও প্রতিরক্ষা বিভ্রান্ত করে ।

প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা:

  • Iron Dome: ছোট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা।
  • David’s Sling: মধ্যপাল্লার (৪০–৩০০ কিমি) জন্য ।
  • Arrow System: LRBM ও ICBM প্রতিরোধে সক্ষম (২ ৪০০ কিমি+ পর্যন্ত) ।

ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের সাথে তুলনা

  • ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র: বিমান-সদৃশ, নিচু উচ্চতায় প্রদক্ষিণ করে, জিপিএস/টেরেইন গাইডেন্স ব্যবহৃত ।
  • তুলনামূলক ভাবে স্লো (Mach 0.5–0.9), তবে নিচু পথ ও মোড় নেওয়ার কারণে প্রতিরক্ষা বিভ্রান্ত হয়।
  • ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দ্রুত, উচ্চতা ও বেগে কেন্দ্র করে আক্রমণ করে, আর ক্রুজ ধীরে কিন্তু নীরবভাবে।

ব্যবহারিক উদাহরণ

ইরান–ইসরায়েল সংঘর্ষ:

  • ইরান ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে শতাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করেছে.
  • কিছু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধরে ফেললেও কিছু লক্ষ্যবস্তুতে এগুলো আঘাত হেনেছে—তেল আবিব সহ কিছু রাজধানী এলাকা ।
  • ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে অন্যতম বৃহৎ ।
  • Mach 5 গতির ক্ষেপণাস্ত্র প্রায় ১২ মিনিটে পৌঁছে ।

সমগ্র মূল্যায়ন

  1. কৌশলগত গুরুত্ব: দ্রুত ও দূর বিস্তৃত আক্রান্তের ক্ষমতা।
  2. প্রতিরক্ষা জটিলতা: উচ্চ বেগ ও বক্র ট্রেজেক্টরি প্রতিরোধ কষ্টকর।
  3. সন্ধিৎসা: ডিকয় ও চাফ প্রযুক্তি প্রতিরক্ষাকে বিভ্রান্ত করে।
  4. প্রযুক্তিগত উন্নয়ন: প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেমন Arrow পাল্লা বাড়ছে, তেমনি হাইপারসনিক অস্ত্রও এগিয়ে চলেছে।
  5. আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা: ICBM দূরত্ব ও গতি বিশ্ব রাজনীতিতে প্রচণ্ড গুরুত্ব বহন করে।
মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button