অর্থনীতি

বাংলাদেশে রিজার্ভ দাঁড়ালো ২৬ বিলিয়ন ডলারের ওপর

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত কয়েক মাসে ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সোমবার পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৬ দশমিক ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক জনাব আরিফ হোসেন খান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

রিজার্ভ বৃদ্ধির পেছনের কারণসমূহ

বাংলাদেশের রিজার্ভের এমন সাফল্যের পেছনে রয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। সর্বপ্রথম, প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈধ পথে নিয়মিত বড় পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে অবদান রেখে যাচ্ছেন। পাশাপাশি, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ থাকায় রিজার্ভ কমানোর পরিবর্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থার ঋণ ও অর্থায়ন দেশের রিজার্ভে সরাসরি যোগ হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রচলিত হিসাব অনুসারে রিজার্ভ বর্তমানে ২৬ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার হলেও, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে আইএমএফ নির্দেশিত বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে তা প্রায় ২০ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার।

গত বছরের তুলনায় রিজার্ভের পার্থক্য

গত ২৭ মে পর্যন্ত দেশের মোট রিজার্ভ ছিল প্রায় ২৫ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার, যা বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে ছিল ২০ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। আর গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার (বিপিএম অনুযায়ী ১৯ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার)। তাই বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বোঝা যাচ্ছে, মাত্র কয়েক মাসে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছে।

প্রবাসী আয়: রিজার্ভ বৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি

কোরবানির ঈদের আগে প্রবাসী আয় দেশের অর্থনীতিতে আশার বাতাস বইয়ে দিয়েছে। চলতি জুন মাসের প্রথম ১৪ দিনে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে প্রবাসীরা প্রায় ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এর আগের মাস, মে মাসে প্রবাসী আয় ছিল ২ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর এপ্রিল মাসে রেকর্ড ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বৈধ চ্যানেলে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকারের প্রণোদনা ও কঠোর তদারকির কারণে এই প্রবৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে। অবৈধ চ্যানেল বন্ধ থাকায় বৈধ রেমিট্যান্সের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সরাসরি রিজার্ভ বাড়াতে সাহায্য করছে।

ডলার বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা: রিজার্ভ রক্ষার কৌশল

চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি থেকে বিরত রয়েছে। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে রিজার্ভ থেকে প্রায় ১২ দশমিক ৭৯ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছিল। আর তার আগের দুই বছর যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার এবং ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রির তথ্য পাওয়া গেছে। চলতি অর্থবছরে ডলার বিক্রি বন্ধ থাকায় রিজার্ভ বাড়তে পেরেছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

আন্তর্জাতিক ঋণ-সহায়তা: রিজার্ভ বৃদ্ধির আরেকটি কারণ

বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ ও অর্থায়নও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে বড় অবদান রেখেছে। চলতি অর্থবছরে এসব সংস্থা থেকে প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ বা অনুদান এসেছে, যা রিজার্ভ বৃদ্ধির সাথে সরাসরি জড়িত।

বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদদের মতামত

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “বর্তমান রিজার্ভ নতুন লক্ষ্য নির্ধারণের তুলনায় বেশি এবং রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমেছে। সব মিলিয়ে রিজার্ভ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য আশাব্যঞ্জক।”

তাঁর মতে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজু যথেষ্ট মাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ায় আগামীর আর্থিক সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ আরও প্রস্তুত।

অন্যদিকে, অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পেলে আমদানি খরচ সাশ্রয় এবং টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক হবে। এ কারণে রপ্তানি খাত ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি ও সরকারের প্রণোদনা

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বৈধ রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর জন্য নানা প্রণোদনা প্রদান করছে। বিশেষ করে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে কর সুবিধা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা চালু করা হয়েছে। এর ফলে প্রবাসী কর্মীরা সহজেই বৈধ পথে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন। এছাড়া অবৈধ চ্যানেলে অর্থ পাঠানোর বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ সরকারের নীতি।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক প্রভাব

বাংলাদেশ সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরবর্তী পরিকল্পনায় রিজার্ভের এই ধারাবাহিক বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস, রপ্তানিতে উৎসাহ বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করাই মূল লক্ষ্য।

বিশ্লেষকদের মতে, এই রিজার্ভ বৃদ্ধির ফলে দেশের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য মিলবে এবং অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও উন্নত হবে, যা পরবর্তী বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক হবে।


সারসংক্ষেপ:

  • বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়ে ২৬.১৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
  • প্রধান কারণ: প্রবাসী আয় বৃদ্ধি, ডলার বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা, ও আন্তর্জাতিক ঋণ প্রাপ্তি।
  • বৈধ রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য সরকার বিভিন্ন প্রণোদনা ও কঠোর তদারকি চালাচ্ছে।
  • অর্থনীতিবিদদের মতে, রিজার্ভ বৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
  • আগামীতেও এই প্রবণতা অব্যাহত রাখতে সরকার নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button