বানিজ্য

ভুটানের ট্রাক বাংলাদেশের পথে, ক্ষোভে ফেটে পড়েছে ভারতীয় চালকরা


বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্যিক পথে ভুটানের ট্রাকের অবাধ যাতায়াত নিয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শিলিগুড়ি এলাকার ট্রাকচালক ও মালিকরা। সোমবার (১৬ জুন, ২০২৫) সকালে জলপাইগুড়ি জেলার ফুলবাড়ী সীমান্তে তারা সড়ক অবরোধ করে অবস্থান নেন। এতে আটকে যায় ভুটান থেকে বাংলাদেশে আসা প্রায় দুই হাজার পণ্যবাহী ট্রাক।

এই ঘটনায় ভারতের পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ফুলবাড়ী সীমান্তে অতিরিক্ত নিরাপত্তা মোতায়েন করে। পরিস্থিতি বর্তমানে শান্ত থাকলেও ক্ষোভ জমে রয়েছে স্থানীয় পরিবহন ব্যবসায়ীদের মাঝে।

বিক্ষোভের মূল কারণ: কেন ক্ষুব্ধ ভারতীয় চালকরা?

ভুটানের ট্রাকগুলো মূলত ভুটান থেকে ভারতের ভূখণ্ড পেরিয়ে পাথর, কয়লা, খনিজ এবং অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী বাংলাদেশে রপ্তানি করছে। কিন্তু ভারতীয় চালক ও মালিকদের অভিযোগ, একই পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে ভারতীয় ট্রাকগুলোকে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য মতে:

  • ভুটানের ট্রাকগুলো সরাসরি ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশে পণ্য পৌঁছে দিচ্ছে।
  • একই সময়ে ভারতীয় ট্রাকগুলোর জন্য অনুমতি সীমিত এবং নিয়মকানুন জটিল।
  • এতে করে ভুটানের ট্রাক ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও ভারতীয় পরিবহন ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

একজন বিক্ষোভকারী ট্রাক মালিক জানান, “আমরা নিজের দেশে থেকে কাজ হারাচ্ছি। এটা কেমন বিচার? সরকার আমাদেরই অবহেলা করছে।”

ভুটান-বাংলাদেশ ট্রানজিট সম্পর্ক: একটি পটভূমি

ভুটান একটি স্থলবেষ্টিত দেশ এবং সমুদ্রবন্দর না থাকায় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করার অনুমতি রয়েছে তাদের। ২০১৫ সালের মধ্যে ভুটান ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত বাণিজ্য চুক্তির আওতায় ভুটান তার পণ্যসম্ভার ভারত হয়ে বাংলাদেশে পাঠাতে পারে।

মূল পণ্যসমূহ:

  • পাথর ও খনিজ (স্টোন চিপস)
  • কাঠ
  • কৃষিজাত পণ্য

এই ট্রানজিট সুবিধায় ভারত অনুমতি দিলেও কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে পরিবহনের ক্ষেত্রে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ভুটানের ট্রাকগুলো বিনা বাধায় এসব পণ্য বাংলাদেশে পৌঁছে দিচ্ছে, যেখানে ভারতীয় ট্রাকচালকদের একই সুবিধা পাচ্ছেন না।

বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে প্রশাসনের অবস্থান

সোমবারের বিক্ষোভের পর পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেবের সঙ্গে দেখা করেন। তারা বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ জানালে মেয়র আশ্বাস দেন দ্রুত সমাধানের।

জাতীয় শ্রমিক ইউনিয়নের স্থানীয় সভাপতি সুকান্ত কর বলেন, “মেয়র সাহেব আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।”

তিনি আরও বলেন, “তবে আমরা কারো আইনসম্মত চলাচলে বাধা দিই না। আমাদের দাবি স্পষ্ট – ভারতীয় ট্রাকগুলোকেও একই সুবিধা দিতে হবে।”

বাংলাদেশের লাভ কী?

বাংলাদেশ এই রুট ব্যবহার করে অনেক কম খরচে ও দ্রুত ভুটানের খনিজ পণ্য আমদানি করতে পারছে। ভুটানের পাথর শিল্পের একটা বড় অংশ এখন বাংলাদেশের উপর নির্ভরশীল।

চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশের বন্দর রাজস্বও বাড়ছে। ফলে দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও গভীর হচ্ছে।

ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যা কোথায়?

ভারত সরকার এই ট্রানজিট অনুমতি দিলেও স্থানীয় পর্যায়ে পর্যাপ্ত সমন্বয় ও ব্যাখ্যার অভাব রয়েছে। ট্রাক ইউনিয়নগুলো মনে করে, এই ট্রানজিট অনুমতির ফলে তাদের কাজ হ্রাস পাচ্ছে।

বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের ট্রাকচালক ও মালিকরা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন, ভুটানের ট্রাকগুলো ভারতীয় চাহিদা ও বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে চলাচল করছে। তারা মনে করছেন, এতে স্থানীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সমীরণ দে বলেন, “এই সমস্যার মূলে রয়েছে নীতিগত অস্পষ্টতা এবং স্থানীয় পর্যায়ে সংলাপের অভাব। ভারতীয় ট্রাকগুলো যদি সমান সুযোগ পায়, তাহলে এই উত্তেজনা কমবে।”

তিনি আরও বলেন, “ভুটান ও বাংলাদেশ এই রুটে অনেক লাভবান হচ্ছে। ভারত শুধু মধ্যবর্তী পথ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও, স্থানীয় পর্যায়ে এর অর্থনৈতিক সুবিধা সঠিকভাবে বিতরণ করা উচিত।”

সমাধান কী হতে পারে?

১. ট্রানজিট নীতিমালার পর্যালোচনা: ভারত সরকারের উচিত ভুটান-বাংলাদেশ ট্রানজিট চুক্তি পর্যালোচনা করে ভারতীয় ট্রাক মালিকদের জন্য সুযোগ বৃদ্ধি করা।

  1. স্থানীয় পর্যায়ে ট্রাক কোটা বরাদ্দ: ভুটান থেকে বাংলাদেশে পাঠানো পণ্যের একটি নির্দিষ্ট অংশ ভারতীয় ট্রাক দিয়ে পাঠানোর সুযোগ তৈরি করা।
  2. সংলাপ ও স্বচ্ছতা: স্থানীয় ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে নীতিগত দিক তুলে ধরা।
  3. একটি যৌথ কমিটি গঠন: তিন দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে নিয়মিত সমস্যাগুলোর সমাধান নিশ্চিত করা।

ভুটান-বাংলাদেশ ট্রানজিট নিয়ে ভারতের ট্রাকচালক ও মালিকদের বিক্ষোভ একটি জটিল সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। আন্তর্জাতিক চুক্তি, স্থানীয় বাস্তবতা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ—তিনটির সমন্বয়ে সমাধান প্রয়োজন। কূটনৈতিকভাবে সঠিক ও অর্থনৈতিকভাবে ন্যায্য সমাধান ছাড়া এই ক্ষোভ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button