ইসরায়েলের ৪৪টি ড্রোন ও কোয়াডকপ্টার ভূপাতিত করার দাবি ইরানের

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সামরিক উত্তেজনা দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। সর্বশেষ পরিস্থিতিতে, ইরানের সীমান্তরক্ষী বাহিনী দাবি করেছে, গত ৪৮ ঘণ্টায় তারা ইসরায়েলের ৪৪টি ড্রোন এবং কোয়াডকপ্টার ভূপাতিত করেছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ‘আইআরএনএ’ এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এই দাবি ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উদ্বেগ বাড়ছে, বিশেষ করে ইসরায়েল ও ইরান উভয়ের সামরিক সক্ষমতা এবং সংঘাতের পরিণতি নিয়ে।
সীমান্তে নজিরবিহীন নিরাপত্তা জোরদার
ইরানের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ আলী গৌদারজি জানান, ইসরায়েলি ড্রোনগুলো ইরানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছিল। তবে তাদের নজরদারি ইউনিট অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেগুলো শনাক্ত করে এবং পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এতে ৪৪টি ড্রোন ও কোয়াডকপ্টারকে আকাশেই ধ্বংস করে ফেলা হয়।
তিনি বলেন, “আমরা আমাদের ভূখণ্ড এবং আকাশসীমা রক্ষায় অটল। কেউ আমাদের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করলে, তার জবাব আমরা অত্যন্ত কঠোরভাবে দেব।”
গত শুক্রবারের ইসরায়েলি হামলা: ক্ষয়ক্ষতি ভয়াবহ
উল্লেখযোগ্য যে, গত শুক্রবার (১৩ জুন) মধ্যরাতে ইসরায়েল প্রথমবারের মতো ইরানের ভেতরে সমন্বিত বিমান, ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। টার্গেট করা হয় ইরানের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা—পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র, সামরিক ঘাঁটি, তেল শোধনাগার ও যোগাযোগ অবকাঠামো। এসব হামলায় দেশটির প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ইরানে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৮ জনে। আহত হয়েছেন আরও প্রায় ৯০০ জন। তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহতদের মধ্যে রয়েছে চিকিৎসাকর্মী, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও সাধারণ নাগরিকরাও।
ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে বলা হয়েছে, রাজধানী তেহরান ছাড়াও ইস্পাহান, কেরমানশাহ ও ইয়াজদের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরে বেসামরিক স্থাপনাও হামলার শিকার হয়েছে।
ইরানের প্রতিশোধমূলক অভিযান
ইসরায়েলের ওই হামলার জবাবে ইরানও সরাসরি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। দেশটির সামরিক বাহিনী ‘অপারেশন শাহাদাতে ইন্তেকাম’ নামে পাল্টা অভিযান চালাচ্ছে। গত দু’দিনে তেহরান থেকে ছোড়া শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ইসরায়েলের বিভিন্ন অঞ্চলে আঘাত হেনেছে। বিশেষ করে রাজধানী তেলআবিব, হাইফা ও আশদোদে ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটেছে।
আল জাজিরা, রয়টার্স ও বিবিসি জানায়, ইরানের হামলায় ইসরায়েলে অন্তত ১৪ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ২০০ জনেরও বেশি। অনেকের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় মৃত্যু সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে কর্তৃপক্ষ। হামলায় টার্গেট করা হয়েছে সামরিক ঘাঁটি, রাডার সিস্টেম, বন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সেনা সমাবেশস্থল।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ
ইরান-ইসরায়েল এই সংঘাতকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়ে উভয় দেশকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হলে এর প্রভাব শুধু অঞ্চলেই নয়, গোটা বিশ্বের ওপর পড়বে।”
যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্সসহ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যরাও দ্রুত অস্ত্রবিরতির আহ্বান জানিয়ে কূটনৈতিক উদ্যোগ জোরদারের ওপর জোর দিচ্ছে। বিশেষ করে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত এবং এর প্রতিক্রিয়ায় তেলআবিবে হামলা – এ দুটি ঘটনা আন্তর্জাতিক আইন ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর হুমকি বলে মনে করা হচ্ছে।
কূটনৈতিকভাবে সমাধানের সম্ভাবনা কতটা?
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল ও ইরানের এই সামরিক উত্তেজনা হঠাৎ কমবে এমন সম্ভাবনা কম। উভয় দেশের নেতৃত্বই নিজেদের জনগণের সামনে শক্তিশালী অবস্থান তুলে ধরতে চায়। ফলে রাজনৈতিকভাবে আপোষে আসা এখনই কঠিন।
তবে আন্তর্জাতিক চাপ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনৈতিক মধ্যস্থতা যদি কার্যকরভাবে শুরু হয়, তবে সংঘাত নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে। তবে এর জন্য উভয় পক্ষকে সমানভাবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে হবে।
ইসরায়েলের যুদ্ধ পরিকল্পনা ও অপারেশন রাইজিং লায়ন
ইসরায়েল কর্তৃক পরিচালিত সামরিক অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে “অপারেশন রাইজিং লায়ন”। এটি একটি বৃহৎ কৌশলগত সামরিক পরিকল্পনার অংশ, যার লক্ষ্য ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক সক্ষমতা দুর্বল করে দেওয়া। তবে এটি শুধু ইরান নয়, গোটা অঞ্চলে যুদ্ধের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে।
হামাস, হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুতি যোদ্ধারা ইরানের পক্ষ নিয়েছে বলে খবরে জানা গেছে। ফলে এই সংঘাত আরও বিস্তৃত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইরান যদি পূর্ণমাত্রায় পাল্টা হামলা চালায়, তবে তা পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে শুরু করে লেবানন, সিরিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বিশ্ববাজারে প্রভাব
মধ্যপ্রাচ্যের এই সামরিক সংঘর্ষের সরাসরি প্রভাব পড়েছে বিশ্ববাজারে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০ ডলার পর্যন্ত বেড়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় ইউরোপ ও এশিয়ার দেশগুলো তাদের কৌশলগত মজুদ বাড়াতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ওপরও এর প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে পেট্রোল, ডিজেল ও গ্যাসের সরবরাহ ও দামের ওপর প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি হলে তা আমদানি ব্যয়, পরিবহন খরচ এবং দ্রব্যমূল্যে প্রভাব ফেলবে।
উপসংহার:
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান এই সামরিক সংঘাত শুধু দুই দেশের নয়, বরং সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। বর্তমানে উভয় পক্ষই শক্ত অবস্থানে রয়েছে এবং যুদ্ধের সম্ভাবনা ক্রমাগত বাড়ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো, কূটনৈতিক চ্যানেলকে কার্যকর করে একটি সমঝোতার পথ খুঁজে বের করা—যাতে আরও প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ এড়ানো যায়।