বিশ্ব

ইরানে হামলার আগে গোপনে ইসরায়েলে হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র

ইরানের ওপর ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বিমান হামলার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সমর্থন ছিল, যা গোপনে চলে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী নিউজ পোর্টাল মিডল ইস্ট আই–এর এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, হামলার কয়েক দিন আগে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৩০০টি অত্যাধুনিক হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলে পাঠায়।

এ ঘটনা প্রকাশ পেয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষত ট্রাম্প প্রশাসন যখন ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক ইস্যুতে আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, তখনই এই গোপন অস্ত্র সরবরাহের তথ্য স্পষ্ট করে দেয় যে, ইসরায়েলের হামলার পরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা ছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের গোপন অস্ত্র সরবরাহ ও ইসরায়েলের হামলার পেছনের কাহিনী

ইসরায়েল গত শুক্রবার ইরানে এক নজিরবিহীন বিমান হামলা চালায়, যা বিশ্বমঞ্চে এক নতুন সংকটের সূত্রপাত করে। যুক্তরাষ্ট্রের গোপন অস্ত্র সরবরাহই ছিল এই হামলার অন্যতম কৌশলগত ভিত্তি।

মিডল ইস্ট আই–এর এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১০ জুন, অর্থাৎ হামলার তিন দিন আগে, ট্রাম্প প্রশাসন গোপনভাবে প্রায় ৩০০টি হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের হাতে তুলে দেয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুই মার্কিন সরকারি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা ইরানে ইসরায়েলের হামলার পরিকল্পনা সম্পর্কে পূর্বেই অবগত ছিলেন এবং সরাসরি সহায়তা দিয়েছেন।

হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্র: ইসরায়েলের প্রধান হাতিয়ার

হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্র হলো লেজারনিয়ন্ত্রিত এক ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র যা আকাশ থেকে স্থলভাগে নির্ভুল আঘাত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। যদিও এটি পারমাণবিক স্থাপনায় বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য সরাসরি ব্যবহৃত হয় না, তবে বিশেষ টার্গেট ধ্বংসে অত্যন্ত কার্যকর।

গত হামলায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী প্রায় ১০০টির বেশি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে। এই বিমানগুলো উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে ইরানের শীর্ষস্থানীয় সামরিক ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য করে আঘাত করে।

ট্রাম্প প্রশাসনের ভূমিকা ও দ্বৈতকথা

মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওস ইসরায়েলের দুই উর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাতে জানায়, ট্রাম্প প্রশাসন প্রকাশ্যে ইসরায়েলের হামলার পরিকল্পনায় বাধা দেয়ার ভান করলেও কার্যত কোনো বাধা দেয়নি। বরং গোপনে হামলার প্রস্তুতি সমর্থন করেছে।

ট্রাম্প প্রশাসন কয়েক মাস আগে থেকেই ইরানের বিরুদ্ধে এই হামলার পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত ছিল। চলতি বছরের এপ্রিল-মে মাসে, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ইসরায়েলকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত করার পরিকল্পনার বিস্তারিত ব্রিফিং দিয়েছিল।

তবে ট্রাম্প শঙ্কা তৈরি করেছিল যে, তিনি নেতানিয়াহুর সরাসরি হামলার আহ্বানে বাধা দিতে পারেন, কিন্তু বাস্তবে তিনি এই হামলার পেছনে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন।

হামলায় নিহত শীর্ষস্থানীয় ইরানি কর্মকর্তারা

ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইরানের উচ্চপদস্থ সামরিক ও পারমাণবিক কর্মকর্তারা নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম:

  • ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) প্রধান মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি
  • ইরানি সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি
  • সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা আলি শামখানি

এই হামলা ইরানের সামরিক শক্তিকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

পারমাণবিক আলোচনা ও ইসরায়েলের হামলা

ট্রাম্প প্রশাসন হামলার আগে ইরানের সঙ্গে একটি নতুন পারমাণবিক চুক্তিতে সম্মত হওয়ার জন্য ৬০ দিনের সময়সীমা দিয়েছিল। কিন্তু ইরান এই সময়সীমায় কোনো আপস করতে রাজি হয়নি। ইসরায়েল এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে হামলা চালায়।

বিগত কয়েক মাসে পারমাণবিক আলোচনায় ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তীব্র বিরোধ দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র চায়, ইরান যেন ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করে, যা তেহরান মেনে নিতে অস্বীকার করে।

যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র চুক্তি ও গোপনীয়তা

যুক্তরাষ্ট্র গোপনে ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করলেও এটি ছিল ৭৪০ কোটি ডলারের অস্ত্র চুক্তির অংশ, যা আগে থেকেই অনুমোদিত ছিল। তাই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আলাদা করে জনসমক্ষে এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।

ইরানের প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

ইরান এ হামলা কঠোরভাবে নিন্দা করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে দায়ী করেছে। তারা বলেছে, এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি। অন্যদিকে, বিশ্ববাজারে তেলের দাম ও নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে।

আন্তর্জাতিক মহলে উত্তেজনা বিরাজ করছে এবং বহু দেশ এই পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষত পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে আলোচনা থেমে গেছে, যা নিরাপত্তার জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের সংকট ও ভবিষ্যৎ

ইরানে ইসরায়েলের হামলার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন সমর্থন একটি নতুন রাজনৈতিক ও সামরিক অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এই ঘটনার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের জটিলতার মাত্রা আরও বেড়েছে।

বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত এই সংকট কমানোর জন্য কূটনৈতিক পথ খোঁজা এবং উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করা। পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা আলোচনা ও আন্তঃদেশীয় সংলাপ আজকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button