বিশ্ব

হজে খুতবা পড়া কে এই সালেহ বিন হুমাইদ

পবিত্র হজ ইসলামের অন্যতম মূল স্তম্ভ। প্রতিবছর আরাফাতের ময়দানে লাখো মুসলমান একত্রিত হন হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য। এই দিনটির সর্বোচ্চ তাৎপর্যপূর্ণ অংশ হলো খুতবাতুল হজ বা হজের খুতবা। ২০২৫ সালের হজ উপলক্ষে আরাফাতের পবিত্র ময়দানে এ বছর হজের খুতবা প্রদান করেছেন ইসলামী দুনিয়ার খ্যাতিমান আলেম, মসজিদুল হারামের ইমাম, শায়েখ ড. সালেহ বিন আব্দুল্লাহ আল হুমাইদ।

কে এই ড. সালেহ বিন হুমাইদ?

শায়েখ ড. সালেহ বিন আব্দুল্লাহ আল হুমাইদ ইসলামী দুনিয়ার একজন শ্রদ্ধেয় আলেম, বিচারপতি ও দার্শনিক। তিনি ১৯৫০ সালে সৌদি আরবের বুরাইদা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ইসলামি আইন ও বিচারব্যবস্থায় তাঁর অবদান বিস্ময়কর এবং সুদীর্ঘ।

মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি মক্কার কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শরিয়াহ বা ইসলামি আইনশাস্ত্রে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামি ফিকাহ ও আইন বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরিয়াহ অনুষদে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং সেখানে ইসলামী অর্থনীতি বিভাগের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

মসজিদুল হারামের ইমাম হিসেবে নিয়োগ

ড. সালেহ আল হুমাইদ মাত্র ৩৩ বছর বয়সে, ১৯৮৩ সালে, পবিত্র কাবা শরিফের অংশ মসজিদুল হারামের ইমাম হিসেবে নিযুক্ত হন। এটি শুধু সৌদি আরবের নয়, বরং বিশ্বের সব মুসলমানের কাছেই এক অনন্য মর্যাদার স্থান। সেই থেকে দীর্ঘ চার দশক তিনি মুসল্লিদের ইমামতি করছেন। তাঁর কণ্ঠে কোরআনের তিলাওয়াত, খুতবা ও বয়ান কোটি কোটি মুসলমানের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে।

বিচারব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা

শুধু ইমাম হিসেবেই নয়, সালেহ বিন হুমাইদ সৌদি আরবের উচ্চপর্যায়ের আইন ও বিচার ব্যবস্থায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি সৌদি আরবের শুরা কাউন্সিল (পরামর্শ পরিষদ)-এর সদস্য ও পরবর্তীতে স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একই সঙ্গে তিনি সৌদি হাই জুডিশিয়ারি কমিশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, যা সৌদির সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও বিচারিক কর্তৃপক্ষগুলোর একটি।

বর্তমানে তিনি উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, সৌদি আরবের সিনিয়র ওলামা কাউন্সিলের সদস্য এবং রাজপরিবারের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।

২০২৫ সালের হজের খুতবা: কী ছিল মূল বার্তা?

পবিত্র আরাফাত দিবসের খুতবায় শায়েখ সালেহ বিন হুমাইদ মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, তাকওয়া, ন্যায়বিচার, সহানুভূতি এবং ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধ বজায় রাখার গুরুত্ব তুলে ধরেন। খুতবার শুরুতেই তিনি আল্লাহর প্রশংসা এবং নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি দরুদ পাঠ করেন।

খুতবায় তিনি বলেন,

“মুসলমানদের মাঝে বিভেদ নয়, ঐক্যই শান্তি আনে। আল্লাহর নির্দেশ মানা, রাসূলের আদর্শ অনুসরণ এবং মানুষকে ভালোবাসা ইসলামি জীবনের মূল স্তম্ভ।”

তিনি মুসলমানদের সৎ ও ইনসাফপন্থী জীবনযাপনের আহ্বান জানান। বিশ্বব্যাপী চলমান মানবিক সংকট, যুদ্ধ ও দুঃখ-কষ্টের প্রেক্ষিতে তিনি মুসলিম নেতাদের প্রতি শান্তির বার্তা ও দায়িত্বশীলতা পালনের আহ্বান জানান।

আরাফাত দিবস: হজের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ দিন

এই বছরের হজে ৫ জুন (বৃহস্পতিবার) ছিল আরাফাত দিবস। বিশ্বের প্রায় ১৬০টি দেশ থেকে প্রায় ২০ লক্ষ মুসলমান পবিত্র মক্কা শরীফে সমবেত হন হজ পালনের জন্য। আরাফাতের ময়দানে দিনভর চলে কোরআন তিলাওয়াত, দোয়া, কান্না ও প্রার্থনা।

এ সময় মুসল্লিদের কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হয়—
“লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক।”
অর্থাৎ, “হে আল্লাহ! আমি হাজির; আপনার কোন অংশীদার নেই; আমি আপনারই জন্য হাজির।”

এই দিনেই হাজিরা সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাত ময়দানে অবস্থান করেন, যা হজের রুকন বা মূল অংশ। এই অবস্থান ছাড়া হজ সম্পূর্ণ হয় না। এরপর তারা রওনা দেন মুজদালিফার দিকে।

ঈদুল আজহার তারিখ ও প্রস্তুতি

সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে শুক্রবার (৬ জুন) ঈদুল আজহা উদযাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোতে ঈদ উদযাপন হবে শনিবার (৭ জুন)। কুরবানির পশু প্রস্তুত, হাটে ভিড়, পরিবারে সাজসজ্জা—সব মিলিয়ে ঈদের আনন্দে ভাসছে মুসলিম বিশ্ব।

কেন গুরুত্বপূর্ণ হজের খুতবা?

হজের খুতবা মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি বৈশ্বিক বার্তা। এখান থেকে বিশ্ব মুসলমানদের জন্য নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে নবী করিম হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, তা-ই প্রথম হজের খুতবা হিসেবে গণ্য করা হয়।

সেই ধারাবাহিকতায় প্রতিবছর খুতবায় ইসলামী সমাজের চ্যালেঞ্জ, করণীয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উপায় তুলে ধরা হয়। সালেহ বিন হুমাইদ-এর মতো অভিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান আলেম যখন এই দায়িত্ব পান, তখন মুসলিম বিশ্ব মনোযোগ দিয়ে খুতবার প্রতিটি শব্দ শোনে ও অনুসরণ করে।

শায়েখ ড. সালেহ বিন হুমাইদ শুধুমাত্র একজন ইমাম বা বিচারক নন, বরং তিনি একজন চিন্তাবিদ, নেতা এবং ইসলামী ঐক্যের প্রতীক। ২০২৫ সালের হজে তার প্রদত্ত খুতবা মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে নৈতিক জাগরণ তৈরি করেছে। বিশ্ব আজ যখন সংকটময় এক বাস্তবতার মুখোমুখি, তখন সালেহ হুমাইদের মতো ব্যক্তিত্বের দিকনির্দেশনা সত্যিই মুসলিম বিশ্বের জন্য আশার আলো।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button