নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দ বাড়ল ২ হাজার কোটি টাকা

আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে নির্বাচন কমিশনের জন্য বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী বছরের জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের জন্য বাজেটে মোট ২ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তুলনায় ১ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা বা ১৫৯ শতাংশ বেশি। এই বরাদ্দের মধ্যে ২ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা পরিচালন ব্যয় এবং ২২৯ কোটি টাকা উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য নির্ধারিত হয়েছে।
বাজেটে নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দ: তুলনামূলক বিশ্লেষণ
গত সোমবার (২ জুন ২০২৫) অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেন। এই বাজেটে নির্বাচন কমিশনের জন্য বরাদ্দের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নির্বাচন কমিশনের সংশোধিত বাজেট ছিল ১ হাজার ১৪২ কোটি টাকা, যার মধ্যে পরিচালন ব্যয় ছিল ৭১৬ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন ব্যয় ছিল ৪২৬ কোটি টাকা। এই তুলনায় আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে পরিচালন ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা, অর্থাৎ ২ হাজার ১১ কোটি টাকা বা প্রায় ২৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, উন্নয়ন ব্যয় কমে ২২৯ কোটি টাকায় নির্ধারিত হয়েছে।
বাজেটের এই বৃদ্ধি মূলত আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটানোর লক্ষ্যে করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন আয়োজনের জন্য পরিচালন ব্যয়ের এই বড় অংশ ব্যবহৃত হবে। এর মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নির্বাচনী সরঞ্জাম সংগ্রহ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় করা হবে।
নির্বাচনের প্রস্তুতি ও বাজেটের তাৎপর্য
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশের ৫৪তম বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, যা এই সরকারের প্রথম বাজেট। আগামী জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য এই বাজেটে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা। এই লক্ষ্য পূরণে পর্যাপ্ত আর্থিক সংস্থান নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয়ের মধ্যে ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার, ভোটার শিক্ষা কর্মসূচি, এবং নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এছাড়া, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার জন্যও অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে।
পূর্ববর্তী নির্বাচনের তুলনায় বরাদ্দ
দেশে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন (দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন) অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে পড়ে। সেই নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের মোট বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন ব্যয় ছিল ২০৯ কোটি টাকা। এই তুলনায় আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বরাদ্দ কিছুটা কম হলেও, পরিচালন ব্যয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি লক্ষণীয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পূর্ববর্তী নির্বাচনের তুলনায় বর্তমান বাজেটে পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার আধুনিকীকরণ এবং ব্যয়বহুল প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে, উন্নয়ন ব্যয় কমানোর বিষয়টি বাজেটের ‘বাস্তবায়নযোগ্য’ করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে, কারণ অর্থ মন্ত্রণালয় চলতি অর্থবছরের তুলনায় মোট বাজেটের আকার ৭ হাজার কোটি টাকা কমিয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ও চ্যালেঞ্জ
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩.৬ শতাংশ। অর্থ উপদেষ্টা জানিয়েছেন, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি এবং ব্যয়ের কার্যকর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা হবে। এই প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, কারণ নির্বাচনের মতো একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করতে পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন।
তবে, রাজস্ব আহরণে কাক্ষিত অগ্রগতি না হওয়া এবং বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান কমে যাওয়ার কারণে বাজেটে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এনবিআরের জন্য আগামী অর্থবছরে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় বেশি। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা না গেলে নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দ বাস্তবায়নে বাধার সম্মুখীন হতে পারে।
নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি ও প্রত্যাশা
নির্বাচন কমিশনের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্তকে সংশ্লিষ্টরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক সংস্থান নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা বেড়েছে। এই বরাদ্দের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদ, ইভিএম ব্যবহার, এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার ক্ষেত্রে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এছাড়া, নির্বাচন কমিশনের উন্নয়ন ব্যয়ের মাধ্যমে প্রযুক্তিগত অবকাঠামো উন্নত করা, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, এবং জনসচেতনতা কার্যক্রম জোরদার করা সম্ভব হবে। তবে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ থাকতে হবে।
উপসংহার
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে নির্বাচন কমিশনের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। এটি দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তবে, বাজেটের সঠিক বাস্তবায়ন এবং রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে এই বরাদ্দ যথাযথভাবে ব্যবহৃত হলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আরও সুদৃঢ় হবে।