প্রযুক্তি

বিগ ব্যাংয়ের পর সবচেয়ে শক্তিশালী মহাজাগতিক বিস্ফোরণ শনাক্ত করলেন বিজ্ঞানীরা

বিস্ময়ে ভরা মহাবিশ্বে ঘটল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই বিস্ফোরণ হতে পারে বিগ ব্যাংয়ের পর এখন পর্যন্ত চিহ্নিত সবচেয়ে শক্তিশালী মহাজাগতিক বিস্ফোরণ। এই বিস্ফোরণের নাম দেওয়া হয়েছে ‘Extreme Nuclear Transients’ (ENT)। এমন বিস্ফোরণ আগে কখনো দেখা যায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাস্ট্রোনমির (IFA) একদল গবেষক ৪ জুন বিখ্যাত জার্নাল Science Advances-এ এই বিস্ময়কর আবিষ্কারের তথ্য প্রকাশ করেন। তাঁরা বলছেন, এই ‘ইএনটি’ নামের বিস্ফোরণ সাধারণ সুপারনোভার তুলনায় ১০০ গুণ বেশি শক্তিশালী, এবং এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী।

কীভাবে এই বিস্ফোরণ ঘটে?

গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. জেসন হিঙ্কল জানিয়েছেন, এই ‘ইএনটি’ বিস্ফোরণ ঘটে তখন, যখন সূর্যের চেয়ে অন্তত তিন গুণ বেশি ভারী একটি নক্ষত্র ধীরে ধীরে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের কাছাকাছি চলে আসে। ব্ল্যাক হোলের বিশাল মাধ্যাকর্ষণ বল সেই নক্ষত্রকে গিলে ফেলে—যার ফলে সৃষ্টি হয় এক অতিকায়, ধ্বংসাত্মক এবং অতি শক্তিশালী বিস্ফোরণ। এই বিস্ফোরণ শুধু উজ্জ্বলই নয়, বছরের পর বছর ধরে আলোকিত থাকে।

পূর্বে এ ধরনের ঘটনা দেখা গেলেও তারা চিহ্নিত ছিল ‘Tidal Disruption Events’ (TDE) নামে, যেগুলো তুলনামূলক কম শক্তিশালী এবং কম সময় ধরে আলো ছড়ায়।

‘গাইয়া’ মিশন থেকেই শুরু আবিষ্কারের

এই বিস্ফোরণ শনাক্ত করার কাহিনি শুরু হয় ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির ‘Gaia’ টেলিস্কোপ দিয়ে। জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেসন হিঙ্কল গাইয়ার মাধ্যমে মহাকাশে অস্বাভাবিক দীর্ঘস্থায়ী আলোর বিকিরণ লক্ষ্য করেন, যা সাধারণ সুপারনোভার আলোর চেয়ে ছিল মসৃণ ও দীর্ঘকালীন।

তবে গাইয়ার মাধ্যমে শুধু বস্তু উজ্জ্বল হয়েছে, তা জানা গেলেও, কেন উজ্জ্বল হয়েছে, সেটা বোঝা যায় না। তাই হিঙ্কল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গবেষকদের সঙ্গে যৌথভাবে একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা শুরু করেন।

এই যৌথ প্রকল্পের মাধ্যমে আরও দুটি বিস্ফোরণ শনাক্ত হয়, যার মধ্যে অন্যতম হলো ‘Gaia 18cdj’। পরবর্তীতে এই তিনটি ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে ‘Extreme Nuclear Transients’ বা সংক্ষেপে ENT নাম দেওয়া হয়।

কতটা শক্তিশালী ছিল এই বিস্ফোরণ?

‘Gaia 18cdj’ নামের বিস্ফোরণটি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, মাত্র এক বছরে এটি ১০০টি সূর্যের সমান শক্তি ছড়িয়ে দেয়। তুলনামূলকভাবে, আমাদের সূর্য তার ১০ বিলিয়ন বছরের জীবদ্দশায় যত শক্তি ছড়ায়, সেটার সমান শক্তি এই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে মাত্র ১২ মাসে! এমন শক্তিশালী বিস্ফোরণ মহাকাশবিজ্ঞানীদের চমকে দিয়েছে।

এই বিস্ফোরণ বিজ্ঞানীদের কী শিখিয়েছে?

বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই বিস্ফোরণগুলো শুধু নক্ষত্র ধ্বংসের ঘটনা নয়, বরং ব্ল্যাক হোলের বিকাশ ও শক্তি সংগ্রহের রহস্যও উন্মোচন করে। ব্ল্যাক হোল সাধারণত আশপাশের বস্তু অনিয়মিতভাবে টেনে নেয়, কিন্তু ইএনটির ক্ষেত্রে একটানা ও স্থায়ীভাবে আলো ছড়ায়—এটা একদম নতুন ধারা।

গবেষণার সহলেখক বেঞ্জামিন শ্যাপি বলেন, “এই আলো এত উজ্জ্বল যে আমরা একে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকেও দেখতে পারছি। মহাবিশ্বের অতীতের সময়কাল—যখন নক্ষত্র ও ব্ল্যাকহোলগুলোর বৃদ্ধির হার ছিল এখনকার চেয়ে ১০ গুণ বেশি—সে সময়ের ঘটনাও আমরা এই বিকিরণের মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি।”

চ্যালেঞ্জও রয়েছে

গবেষকরা জানিয়েছেন, সাধারণ সুপারনোভার মতো এই ENT বিস্ফোরণ প্রতিদিন বা প্রতি মাসে ঘটে না। বরং এদের দেখা পাওয়ার হার ১ কোটি গুণ কম। তাই ভবিষ্যতে এই বিস্ফোরণগুলোর ওপর গবেষণার জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতা, উন্নত পর্যবেক্ষণ সরঞ্জাম, এবং বিজ্ঞানমনস্ক জনসাধারণের সহায়তা।

ভবিষ্যতের দিকে চোখ

এই বিস্ফোরণগুলি ভবিষ্যতে আমাদের মহাবিশ্বের গঠন, নক্ষত্রের জীবনচক্র ও ব্ল্যাক হোলের রহস্য উন্মোচনে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। ENT নিয়ে গবেষণা চলমান থাকবে এবং আরও শক্তিশালী টেলিস্কোপ ও গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে এদের নিয়ে আরও বিস্ময়কর তথ্য সামনে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button