বিশ্ব

গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো: বিশ্বজুড়ে সমালোচনার ঝড়

গাজা উপত্যকায় দীর্ঘদিন ধরে চলমান রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত এক প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো দেওয়ার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ৪ জুন অনুষ্ঠিত এই ভোটাভুটিতে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট নিরাপত্তা পরিষদের ১৪টি দেশ প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দিলেও একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে ভেটো দেয়, ফলে এটি বাতিল হয়ে যায়।

কি ছিল প্রস্তাবে?

নিরাপত্তা পরিষদের এই প্রস্তাবে গাজায় অবিলম্বে, নিঃশর্ত ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে সেখানে জিম্মি থাকা ইসরায়েলি নাগরিকদের মুক্তির বিষয়টিও তুলে ধরা হয়। প্রস্তাবটি ১০টি সদস্য দেশের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবটিকে “গ্রহণযোগ্য নয়” বলে উল্লেখ করে।

যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতির আহ্বান এবং জিম্মিদের মুক্তির মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করা হয়নি, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাটতি।

যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান: ‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে’

জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ডরোথি শিয়া পরিষদের বৈঠকে বলেন, “সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট—ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। সেই অধিকার প্রয়োগ করে তারা হামাসকে পরাজিত করতে চায় এবং ভবিষ্যতে যেন আর হামাস তাদের জন্য হুমকি না হয়, তা নিশ্চিত করতে চায়।”

ডরোথি শিয়া আরও বলেন, “এই প্রস্তাবটি দ্বিমুখী সংকেত দেয় এবং জিম্মি মুক্তির বিষয়টি যুদ্ধবিরতির সঙ্গে যথাযথভাবে সংযুক্ত করা হয়নি। এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্র এর বিরোধিতা করেছে।”

মানবিক সংকটের বাস্তব চিত্র

ভোটাভুটির দিন ও তার আগের ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় গাজায় অন্তত ১০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু বলে জানা গেছে। গাজার বেশিরভাগ এলাকাতেই মানবিক সহায়তা, খাবার, ওষুধ এবং চিকিৎসা সামগ্রী প্রবেশ একপ্রকার সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে আছে।

জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, গাজায় এই মুহূর্তে ভয়াবহ মানবিক সংকট চলছে। খাদ্য, পানীয় ও চিকিৎসার অভাবে হাজার হাজার মানুষ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।

চীনের কড়া ভাষা: ‘মানবিক আইনের সীমা ছাড়িয়ে গেছে’

চীনের রাষ্ট্রদূত ফু কং নিরাপত্তা পরিষদে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, “ইসরায়েলের কার্যকলাপ আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের প্রতিটি সীমারেখা অতিক্রম করেছে। তারা জাতিসংঘের প্রস্তাবনাগুলোকেও গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করছে। তারপরও একটি মাত্র দেশ—যুক্তরাষ্ট্র—ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধা দিচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “এই ভেটোর মাধ্যমে নিরাপত্তা পরিষদ তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি মানুষের আস্থা হারিয়ে যাবে।”

বিশ্লেষণ: যুক্তরাষ্ট্র একঘরে?

আল–জাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা মন্তব্য করেছেন, “এই ভেটোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে অনেকটাই একঘরে হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অধিকাংশই যুদ্ধবিরতির পক্ষে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র দেশ হিসেবে এর বিরোধিতা করে গাজায় মানবিক বিপর্যয় দীর্ঘায়িত করছে।”

তিনি আরও বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র যে কেবল ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধবিরতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে তা নয়—তারা আসলে গাজায় ইসরায়েলি দখলদারি ও অবরোধকে রক্ষা করছে।”

গাজা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট: টানা ৮ মাসের রক্তক্ষয়

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে গাজায় যুদ্ধ শুরু হয়। এরপর থেকেই সেখানে একের পর এক সামরিক অভিযান চালাচ্ছে ইসরায়েল। এখন পর্যন্ত এই সংঘাতে ৩৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের বড় অংশই নারী ও শিশু।

এছাড়া বহু বাসিন্দা গৃহহীন হয়ে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। ইউএনআরডব্লিউএ (UNRWA)-র মতে, গাজায় প্রায় ১৮ লাখ মানুষ এখন মানবিক সহায়তার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল।

জাতিসংঘে গাজা বিষয়ে ভোটাভুটি: একটি পরিসংখ্যান

সালমোট প্রস্তাবপাস হয়েছেভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
২০২৩-২০২৫১৪টি৪টি৭টি

গতকালকের (৪ জুন ২০২৫) ভোট ছিল ২০২৪ সালের নভেম্বরের পর প্রথম ভোটাভুটি। আন্তর্জাতিক মহলের মতে, এই দীর্ঘ বিরতির ফলে গাজা পরিস্থিতির ওপর নতুন করে নজর দেওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ভেটোর মাধ্যমে সেই সম্ভাবনাও ভেস্তে গেল।

বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া

  • ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই ভেটোকে “হতাশাজনক” বলে মন্তব্য করেছে।
  • তুরস্ক ও কাতার এর নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এটি মানবতার বিরুদ্ধে অবস্থান।
  • দক্ষিণ আফ্রিকা বলেছে, গাজার নিরীহ জনগণকে এই ভেটো মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।

গাজার যুদ্ধবিরতি আর কত দূর?

যখন গাজায় প্রতিদিন সাধারণ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে, এবং পুরো একটি জাতি ধ্বংসের মুখোমুখি—তখন আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও ভেটোর রাজনীতি যেন মানবিকতা হারিয়ে ফেলেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দায়িত্ব হলো শান্তি নিশ্চিত করা, কিন্তু একদেশের ভেটোর মাধ্যমে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো দিন দিন দুরূহ হয়ে পড়ছে।

বিশ্ববাসীর প্রশ্ন—গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য আর কত মানুষকে মরতে হবে?

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button