ক্রিপ্টোকারেন্সি: অর্থনৈতিক বিপ্লব না ডিজিটাল জুয়া

ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইউটিউবের বিজ্ঞাপনগুলোয় আজকাল প্রায়ই চোখে পড়ে – “বিটকয়েন কিনুন, লাখপতি হোন”। কেউ কেউ দাবি করছেন, এটি আধুনিক অর্থনীতির এক বিপ্লব, আবার কারও মতে এটি প্রযুক্তির ছদ্মবেশে ভয়াবহ এক জুয়ার আসর।
ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আজকের নয়। একদিকে প্রযুক্তি আগ্রাসনের যুগে মানুষ চাইছে দ্রুত ও সহজ লেনদেনের সমাধান, অন্যদিকে এর নেপথ্যে রয়েছে অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তা ঝুঁকি, আর্থিক প্রতারণা এবং বৈধতার প্রশ্ন।
ক্রিপ্টোকারেন্সি কী?
ক্রিপ্টোকারেন্সি হলো একধরনের ডিজিটাল বা ভার্চুয়াল মুদ্রা, যা ক্রিপ্টোগ্রাফিক প্রযুক্তি দিয়ে নিরাপদ করা হয়। এটি বাস্তবে কোনো কাগজ বা ধাতব রূপে বিদ্যমান নয়। বিটকয়েন, ইথেরিয়াম, ডজকয়েন, রিপল, সোলানা ইত্যাদি বর্তমানে জনপ্রিয় ক্রিপ্টোকারেন্সি।
প্রতিটি ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্লকচেইন নামে পরিচিত এক ধরনের বিকেন্দ্রীভূত প্রযুক্তিতে ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। এই ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে প্রতিটি লেনদেন রেকর্ড হয় একাধিক নোডে, যা পরিবর্তন বা জালিয়াতি প্রায় অসম্ভব করে তোলে।
ইতিহাসের পেছনে সাতোশি
২০০৯ সালে ‘সাতোশি নাকামোতো’ নামের এক ছদ্মনামধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী প্রথম চালু করেন বিটকয়েন। মূল উদ্দেশ্য ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছাড়াই এক মুক্ত, স্বতন্ত্র আর বিকেন্দ্রীকৃত মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
প্রথমদিকে এটি সীমিত পরিসরে ব্যবহার হলেও ২০১3 সালের পর বিটকয়েন মূলধারার সংবাদমাধ্যমে আসতে শুরু করে এবং ২০১৭ সালে ভয়াবহ মূল্যে উত্থান-অবনমনের কারণে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ক্রিপ্টোকারেন্সি
বিশ্বে ২০২৪ সালের মধ্যে ২৫ হাজারেরও বেশি ধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সি চালু হয়েছে। এদের মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করে আছে বিটকয়েন ও ইথেরিয়াম। এল সালভাদর বিটকয়েনকে রাষ্ট্রীয় মুদ্রা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে, যেখানে অন্য অনেক দেশ এখনো দ্বিধায়।
যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো কর কাঠামোর আওতায় এনে নিয়ন্ত্রিত বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, চীন ক্রিপ্টোকারেন্সিকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। ভারত কর আরোপ করে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, কিন্তু এখনো এটি বৈধ মুদ্রা নয়।
বাংলাদেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির অবস্থা
বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালেই বিটকয়েনসহ অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সিকে অবৈধ ঘোষণা করে। বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিকবার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, এসব মুদ্রায় লেনদেন বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনের পরিপন্থী।
২০২২ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মুখপাত্র আবুল কালাম আজাদ জানান, “ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে রাগ পুলিং, পঞ্জি স্কিম, ফিশিংসহ বিভিন্ন প্রতারণার ঘটনা বেড়েছে।”
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও পুলিশের সাইবার ইউনিট একাধিকবার অভিযানে অনলাইনে প্রতারণার চক্র ভেঙেছে, যারা সাধারণ মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে বিটকয়েন ও অন্যান্য কয়েন বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
ঝুঁকির মুখে কারা?
বিশেষজ্ঞদের মতে, সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন নতুন ও অনভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা। তারা উচ্চ লাভের আশায় বিনিয়োগ করে, কিন্তু বাজারের অস্থিরতা ও প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হন।
ক্রিপ্টোকারেন্সির মূল সমস্যা হলো এর অস্থিরতা। একদিনে ২০-৩০ শতাংশ দাম উঠানামা অত্যন্ত সাধারণ। তদুপরি, ‘পাম্প অ্যান্ড ডাম্প’ পদ্ধতিতে বড় বিনিয়োগকারীরা দাম বাড়িয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সর্বস্বান্ত করে দেন।
শিক্ষার্থী, গৃহবধূ, এমনকি অবসরপ্রাপ্তরাও নানা সময় এই ‘ডিজিটাল স্বপ্নে’ পা দিয়ে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে, ইউটিউব চ্যানেলে প্রতিনিয়ত এই ধরনের প্রলোভনমূলক বিজ্ঞাপন চলতেই থাকে।
ভবিষ্যৎ কী বলছে?
অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, ক্রিপ্টোকারেন্সি ভবিষ্যতের একটি সম্ভাব্য লেনদেন ব্যবস্থা হতে পারে, তবে এখনই সেটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা কঠিন। কারণ, অধিকাংশ দেশে এখনো প্রযুক্তিগত অবকাঠামো, সুরক্ষা, নীতিমালা ও জনসচেতনতার ঘাটতি রয়েছে।
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর মতে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ক্রিপ্টোকারেন্সি এখনই চালু করলে সেটা অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
তবে প্রযুক্তির গতিপথ দেখে এটিও অনস্বীকার্য যে ভবিষ্যতে ডিজিটাল মুদ্রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সেই ক্ষেত্রে প্রয়োজন নীতিসম্পন্ন গ্রহণযোগ্যতা, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি জনগণের মধ্যে সচেতনতা।
জুয়া না বৈপ্লবিক প্রযুক্তি?
এই প্রশ্নের সহজ উত্তর নেই। কারণ একদিকে এটি প্রতারণা, স্ক্যাম ও অনিশ্চয়তার একটি ক্ষেত্র, অন্যদিকে এটি হতে পারে একটি দৃষ্টান্তমূলক অর্থনৈতিক পরিবর্তনের বাহক।
বিশ্বের প্রযুক্তি জগতে ব্লকচেইন, ওয়েব৩ ও মেটাভার্সের সঙ্গে ক্রিপ্টোকারেন্সির ভূমিকা বাড়ছেই। কিন্তু এর গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করবে ভবিষ্যতের নীতিনির্ধারক, প্রযুক্তিবিদ এবং সমাজের সম্মিলিত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
উপসংহার
ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য আজকের জগতে খুব স্বাভাবিক। কিন্তু প্রযুক্তির এ যুগে অজ্ঞতা, লোভ ও অনিয়ন্ত্রিত বিনিয়োগ আমাদের শুধু আর্থিকভাবে নয়, সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
তাই ব্যক্তি, সরকার ও সমাজকে একসঙ্গে এই প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং উপযুক্ত সময় ও পরিবেশ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত সচেতনভাবে দূরে থাকাই শ্রেয়।