হালুয়াঘাটে ঈদুল আজহা উপলক্ষে বরাদ্দকৃত ৯৫ বস্তা সরকারি চাল উদ্ধার

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে ঈদুল আজহা উপলক্ষে হতদরিদ্রদের জন্য বরাদ্দকৃত ৯৫ বস্তা সরকারি চাল একটি ব্যবসায়ীর বাড়ি ও দোকানঘরে অবৈধভাবে মজুত অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার (৩ জুন) রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে এ চাল উদ্ধার করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে আবদুর রশিদ (৫৫) নামের এক ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়েছে।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এলাকাজুড়ে ব্যাপক উত্তেজনা ও নিন্দার সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন এবং সাধারণ মানুষ বিষয়টিকে সরকারি ত্রাণচাল আত্মসাতের একটি উদ্বেগজনক দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখছেন।
কোথা থেকে কত বস্তা চাল উদ্ধার?
হালুয়াঘাট থানা পুলিশ জানায়, প্রথমে উপজেলার শাকুয়াই ইউনিয়নের রামনাথপুর এলাকায় আবদুর রশিদের নিজ বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে ৬৮ বস্তা চাল জব্দ করা হয়। প্রতিটি বস্তায় ছিল ৩০ কেজি করে চাল। পরে আটক রশিদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী রাত ১২টার দিকে উপজেলার ভাট্টা বাজারে তাঁর দোকানঘর থেকে আরও ২৭ বস্তা চাল উদ্ধার করা হয়।
এ নিয়ে মোট ৯৫ বস্তা চাল (২ হাজার ৮৫০ কেজি) উদ্ধার করা হয়েছে, যেগুলো মূলত ঈদুল আজহা উপলক্ষে গরিব ও অসহায় মানুষের মাঝে বিতরণের জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দ ছিল।
ব্যবসায়ীর দাবি: ‘আমি জানতাম না এটা বেআইনি’
আটক আবদুর রশিদ পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, তিনি এই চাল উপকারভোগীদের কাছ থেকেই কিনেছেন, প্রতি বস্তা ১ হাজার ১০০ টাকায়। তিনি আরও বলেন, “আমি জানতাম না, এই চাল কেনা বেআইনি। এটা আমার ভুল হয়েছে। আমি এসব বিক্রির জন্যই জমা করেছিলাম।”
তবে পুলিশের মতে, সরকারি চালের প্যাকেট, সিল ও অন্যান্য তথ্য থেকে এটি স্পষ্ট যে এগুলো বিতরণের আগেই কিংবা বিতরণের সময় উপকারভোগীদের কাছ থেকে বেআইনিভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে।
সরকারি ত্রাণচাল কি এভাবে কেনাবেচা করা বৈধ?
না, মোটেই বৈধ নয়। সরকারের পক্ষ থেকে বিতরণকৃত চাল কোনো ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী কিনতে বা মজুত করতে পারেন না। খাদ্য অধিদপ্তরের বিধি অনুযায়ী, ভিডব্লিউবি (Vulnerable Group Feeding/VGF) ও ভিডব্লিউবি (Vulnerable Group Development/VGD) কর্মসূচির আওতায় প্রাপ্ত চাল সম্পূর্ণ বিনামূল্যে উপকারভোগীদের মধ্যে বিতরণযোগ্য।
সরকারি চাল বিক্রি, কেনা বা মজুত করা দণ্ডনীয় অপরাধ, যা ফৌজদারি আইনের আওতায় পড়ে এবং দোষী সাব্যস্ত হলে জেল ও জরিমানা উভয় শাস্তি হতে পারে।
কী ছিল এই চালের উৎস?
জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ভিডব্লিউবি কর্মসূচির আওতায় উপজেলার শাকুয়াই ইউনিয়নে দরিদ্রদের মধ্যে এই চাল বিতরণ কার্যক্রম চলছিল। ঈদুল আজহা উপলক্ষে প্রতিজন উপকারভোগীকে তিন বস্তা করে চাল দেওয়া হয়, যা আগে দুই বস্তা ছিল।
শাকুয়াই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ইউনুস আলী খান বলেন, “আমরা কয়েক দিন আগে দুই বস্তা করে দিয়েছিলাম। মঙ্গলবার আরও তিন বস্তা করে বিতরণ করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, কেউ কেউ চাল বিক্রি করে দিয়েছেন ঈদের বাড়তি খরচ মেটাতে।”
তিনি আরও বলেন, “আমি উপকারভোগীদের আগেই নিষেধ করেছিলাম চাল না বিক্রি করতে। কিন্তু কিছু লোকজন নিয়ম না মেনে গোপনে বিক্রি করে ফেলেছেন বলে ধারণা করছি।”
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া: সরকারি চাল নিয়ে বাণিজ্য মেনে নেওয়া যায় না
এই ঘটনার পর স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, “আমরা যারা প্রকৃত অর্থে অসহায়, তাদের জন্য বরাদ্দকৃত চাল যদি বাজারে বিক্রি হয়ে যায়, তাহলে ঈদে আমরা কী খাব?”
আরেকজন বলেন, “জনপ্রতিনিধিরা ঠিকমতো তদারকি করলে হয়তো এই অনিয়ম ঘটত না। এখন পুলিশের ধরার পর সবাই জানছে।”
প্রশাসনের বক্তব্য: ‘আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন’
হালুয়াঘাট থানার উপপরিদর্শক শুভ্র সাহা বলেন, “গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে ৯৫ বস্তা সরকারি চাল উদ্ধার করা হয়েছে এবং একজনকে আটক করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, উপকারভোগীদের কাছ থেকে চালগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।”
তিনি আরও জানান, “আমরা এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট আরও ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে কাজ করছি। এ বিষয়ে খাদ্য অফিস ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে।”
অতীতেও ঘটেছে এমন ঘটনা
এটি নতুন কোনো ঘটনা নয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়েই সরকারি ত্রাণ ও বরাদ্দকৃত খাদ্যশস্য দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এসেছে। বিশেষ করে উৎসবের সময় বিভিন্ন এলাকায় বিতরণ করা চাল কালোবাজারে বিক্রি হয়ে যাওয়ার অভিযোগ বহুবার প্রমাণিত হয়েছে।
২০১৯ সালে কুড়িগ্রামে ৪০ বস্তা সরকারি চাল উদ্ধার হয়েছিল একটি ব্যবসায়ীর দোকান থেকে। তখনও ব্যবসায়ী একই রকম দাবি করেছিলেন—“জানি না এটা বেআইনি।”
কীভাবে রোধ করা যাবে এ ধরনের অনিয়ম?
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি চাল বিতরণের ক্ষেত্রে আরও স্বচ্ছ ও ডিজিটাল পদ্ধতি গ্রহণ করা দরকার। যেমন:
- উপকারভোগীদের ডিজিটাল তালিকা করা
- এসএমএস বা বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে চাল বিতরণ নিশ্চিত করা
- চাল বিতরণের পর ফলোআপ টিমের মাধ্যমে যাচাই করা
এছাড়াও জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয়ভাবে তদারকি, স্থানীয়দের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পুলিশের নজরদারি বাড়ালে এ ধরনের দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব।