বানিজ্য

১০ লাখ টাকা করে ঋণ পাবেন ১০ হাজার উদ্যোক্তা

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতের অবদান ক্রমেই বাড়ছে। নতুন অর্থবছর ২০২৫-২৬ এর বাজেটে এ খাতের বিকাশে নেওয়া হয়েছে একাধিক সময়োপযোগী ও সাহসী পদক্ষেপ। বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী তিন বছরের মধ্যে দেশে ১৫ হাজার নতুন উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যে বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এই পরিকল্পনার আওতায় ১০ হাজার উদ্যোক্তাকে ১০ লাখ টাকা করে মোট ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হবে।

অর্থ উপদেষ্টা আরও জানিয়েছেন, এ উদ্যোগের আওতায় প্রান্তিক পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য থাকছে আলাদা সুবিধা ও করপোরেট সংযোগ স্থাপনের সুযোগ। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নে গঠিত হবে কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ, দেওয়া হবে দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ, এবং দেশের বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে গড়ে তোলা হবে পণ্যের প্রদর্শনী ও বিক্রয়কেন্দ্র।

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ১০ লাখ টাকার ঋণ

নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনায় সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রান্তিক পর্যায়ের সিএমএসএমই খাতের ১০ হাজার উদ্যোক্তাকে ১০ লাখ টাকা করে ঋণ দেওয়া হবে। এ জন্য বরাদ্দ থাকবে ১ হাজার কোটি টাকা। এর মাধ্যমে দেশে একটি শক্তিশালী ও টেকসই উদ্যোক্তা গোষ্ঠী গড়ে তোলা সম্ভব হবে।’

এ ঋণ সুবিধা পেতে উদ্যোক্তাদের নির্দিষ্ট মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে হবে। গঠন করা হবে কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ, যাতে প্রকৃত উদ্যোক্তারা যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এই সুবিধা পান। ব্যাংকিং প্রক্রিয়া সহজ করতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হবে, যাতে আবেদন প্রক্রিয়া হয় স্বচ্ছ ও দ্রুতগতির।

নারীদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ

বাজেট বক্তৃতায় নারী উদ্যোক্তাদের প্রসঙ্গে বিশেষ গুরুত্ব দেন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ৩ হাজার নারী উদ্যোক্তার সঙ্গে করপোরেট ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সংযোগ স্থাপন করা হবে।’

এ উদ্যোগের ফলে নারী উদ্যোক্তারা তাদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি করপোরেট হাউসগুলোর কাছে বিক্রি করার সুযোগ পাবেন। ফলে বাজারে প্রবেশাধিকার যেমন সহজ হবে, তেমনি পণ্যের মূল্যও ন্যায্য পাওয়া যাবে। নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা ও মেন্টরশিপ সুবিধাও দেওয়া হবে।

প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী ও পণ্য মেলা

বাজেটে সিএমএসএমই খাতের দক্ষতা উন্নয়নে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘২৫ হাজার উদ্যোক্তাকে কারিগরি ও দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে।’ এতে করে উদ্যোক্তাদের ব্যবসা পরিচালনার সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং নতুন পণ্যের উদ্ভাবনে উৎসাহিত হবেন তারা।

এছাড়া, বিভাগীয় শহরে প্রতিষ্ঠা করা হবে এসএমই প্রোডাক্ট ডিসপ্লে ও সেলস সেন্টার। জেলা শহরে আয়োজন করা হবে আঞ্চলিক এসএমই পণ্য মেলা, যেখানে উদ্যোক্তারা তাদের পণ্য প্রদর্শন এবং বাজারজাত করতে পারবেন। এসব আয়োজন স্থানীয় পর্যায়ে বাজার সম্প্রসারণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।

জিডিপিতে সিএমএসএমই খাতের অবদান

গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপিতে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অবদান ছিল প্রায় ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ। বাজেট বক্তৃতায় এই তথ্য তুলে ধরে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘এই সম্ভাবনাময় খাতকে আরও এগিয়ে নিতে সরকার উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে যাচ্ছে।’

এই খাতের বিকাশ কেবল অর্থনীতিকেই নয়, বরং কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থানের পথও প্রসারিত করবে। দেশের যুব সমাজকে উদ্যোক্তা হতে উদ্বুদ্ধ করাও এই নীতির অন্যতম লক্ষ্য।

লজিস্টিকস ও বাণিজ্যিক পরিবেশ উন্নয়ন

সিএমএসএমই খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত সরবরাহ চেইন এবং পণ্য পরিবহনে কার্যকর সমাধান দিতে সরকার লজিস্টিকস খাতের উন্নয়নে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

অর্থ উপদেষ্টা জানান, বাণিজ্যিক সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোটের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর ও বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এতে করে দেশীয় পণ্যের রপ্তানি সম্ভাবনা যেমন বাড়বে, তেমনি উদ্যোক্তারা নতুন বাজার খুঁজে পাবেন।

বাজেটের সার্বিক আকার ও দৃষ্টিভঙ্গি

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।

এই বাজেটকে সরকার ‘উন্নয়নবান্ধব’ ও ‘উদ্যোক্তা সহায়ক’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, সিএমএসএমই খাতকে কেন্দ্র করে বাজেটের এই অংশটি বাস্তবায়ন হলে স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হবে এবং বেকারত্ব কমবে।

শেষ কথা

বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে হলে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে এগিয়ে নেওয়া সময়ের দাবি। নতুন বাজেটে যে ধরনের বাস্তবধর্মী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, তা সত্যিই আশাব্যঞ্জক। তবে বাজেট ঘোষণার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে এর যথাযথ বাস্তবায়ন।

সরকার, বেসরকারি খাত, ব্যাংক ও উদ্যোক্তাদের সমন্বিত প্রয়াসে এই কার্যক্রম সাফল্য অর্জন করলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই একটি শক্তিশালী এবং টেকসই উদ্যোক্তা ভিত্তি তৈরি হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button